মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। ত্রই সেরা জীবটি শৈশবে মাতৃক্রোড়ে থেকে যে ভাষায় সর্বপ্রথম কথা শুনে ও বলে সেই ভাষাই তার মাতৃ ভাষা। তাই সেই ভাষার বর্ণের সাথে তার সর্বাগ্রে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। নিজের মাতৃ ভাষায় সম্পূর্ণ রূপে শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে বিশ্বের অন্যান্য ভাষা, শিক্ষা , সংস্কৃতি ও দেশ সম্বন্ধে কোন জ্ঞান অর্জন সম্ভব হবেনা। তাই কবি বলেছেন——-
“নানা-ন দেশের নানা-ন ভাষা // বিনা স্বদেশী ভাষা মিটেকি আশা”
আমি বাঙ্গালী, আমার মাতা- পিতা, মাতা-মহ, পিতা-মহ- বংশানুক্রমিক বাঙ্গালী। আমার জানামতে বিশ্বের ইতিহাসে রাজা- রাজায় বা রাজা- প্রজায় ; জন – মহাজনে; পিতা – পুত্রে, ভাই- বোনে, স্বামী – স্ত্রীতে, দার্শণিক- দার্শণিকে বৈজ্ঞানিক- বৈজ্ঞানিকে; সা¤্রাজ্য নিয়ে, অধিকার নিয়ে, দেনা- পাওনা নিয়ে, কর্ম- কর্তব্য নিয়ে, মতবাদ নিয়ে, যুক্তি- তর্ক, আধিপত্য, যুদ্ধ- বিগ্রহ ইত্যাদিতে একে অপরের প্রতিদ›িদ্বতা করছে। যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু বিশে^র কোন জাতি তার মাতৃভাষায় কথা বলতে গিয়ে বাধা প্রাপ্তÍ হয়নি, প্রাণ দিতে হয়নি, প্রাণ দিতে হয়েছে একমাত্র বাঙ্গালী জাতিকে ১৯৫২ সালে।
একুশে ফেব্রæয়ারি বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালীর জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎস হচ্ছে এ দিনটি। তাই আমরা এই দিনটিকে ভুলতে পারিনা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন ২১ শে ফেব্রæয়ারি। এই দিনেই বাঙ্গালীর তাজা রক্ত রাজপথে ঝড়েছিল। রক্ত ঝড়া দিনে বাঙালী ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার প্রেরণা অনুভব করেছিল। এ দিনটিকে কোন ক্রমেই ভুলা যায় না। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়——–
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি // আমি কি ভুলিতে পারি।”
১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর আ¤্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত গেলে দীর্ঘ ১৯০ বৎসর অমানিশার অন্ধকারে থেকে অত্যাচার, জেল, জুলুম, দ্বিপান্তর, ফাঁসির রশিতে ঝুলে বহু প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সা¤্রাজ্য বাদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান। উল্লেখ্য পাকিস্তান নাম করণের সময় পূর্ববঙ্গকে বঞ্চিত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির ঊষালগ্নে আলীগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন উর্দ্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে পূর্ববঙ্গ থেকে জ্ঞান-তাপস, পন্ডিতকুল শীরমনি ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করেন। এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী উত্থাপন করেন। (১১ই শ্রাবন ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ) এভাবেই পাকিস্তান জন্মের আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
এদেশের বৃহত্তর জন গোষ্ঠির মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্তে¡ও পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে উর্দ্দুকে বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্ত চলতে থাকে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ও খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন উর্দ্দু-উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে উক্ত সমাবেশে তুমুল প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। জিন্নাহর এই ঘোষনার পর থেকেই বাংলা ভাষার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্টি যতই বাংলা ভাষার বিরোধিতা করতে থাকে বাংলা ভাষার আন্দোলন ততই জোরদার হয় এবং প্রাণ পায়। প্রাথমিক ভাবে ছাত্ররা আন্দোলনের সূত্রপাত করলে পরবর্তীতে সমগ্র দেশবাসী ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। দেশবাসীর সমর্থনে ছাত্রদের মনোবল বহু-বহুগুনে বেড়ে যায়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারীতে প্রাদেশিক পরিষদ এর অধিবেশনকে সামনে রেখে সমগ্র দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে আন্দোলন বেগবাণ করা হয়। স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার মিছিল সমাবেশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রæয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে সাথে সাথে পুলিশ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে সালাম, রফিক, জাব্বার, বরকত ও আরো অনেকে শহীদ হন।
বৃটিশ সম্রাজ্য বাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বড় আশা নিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলতে গিয়ে ভাইয়ের গুলিতে যখন ভাইয়ের প্রাণ নাশ হয়েছিল, আমার মনে হয় তখন এই বাংলার জলে স্থলে অন্তরিক্ষে শুধু একটি কবিতার দুটি চরণ উচ্চারিত হয়েছিল-
এই কি গো তোমার সোনার প্রতিমা- // এই কি গো তোমার মধুর বেশ।
পরাধীন যবে ছিলাম মাগো- // তখনিতো মোরা ছিলাম বেশ।
এ হত্যা যজ্ঞ ও দমন নীতির কথা সারা দেশে বিদ্যুত বেগে ছড়িয়ে পড়লে দেশবাসী বিক্ষুবে ফেটে পড়ে। কারণ ধুমায়িত অসন্তোষ বেশী দিন চাপা থাকে না। তখন আতংকিত শাসক দল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিতে বাহানার আশ্রয় নেয়। এই ভাবে চারটি বছর অতিবাহিত করে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।তাই কিশোর কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে হয়-
“সাবাস বাংলা দেশ // এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়।
জলে পুড়ে মরে ছাড় খার // তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
এত সংগ্রাম এত ত্যাগ তিতিক্ষা, এত রক্ত ঝড়ানোর পড়ও স্বৈরাচার শাসক গুষ্ঠির কাজ কর্মে বাংলা যে রাষ্ট্রভাষা তা প্রমাণিত হয়নি। ১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান সংবিধান কে স্থগিত করে সমগ্র দেশে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং বাঙ্গালী জাতীয় নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরে পূর্ব সুরিদের কায়দায় দেশ চালাতে থাকেন কিন্তু বাঙ্গাঁলীরা প্রতিবাদ মিটিং মিছিল ও বিক্ষুব প্রদর্শন করতে থাকেন। এমনি ভাবে ১৯৬৯ সালে গণ অভ্যুথনের মাধ্যমে নেতৃবৃন্দ মুক্তি পায়। অপর দিকে আইয়ূব খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তার স্থলাবিষিক্ত হয় জে: ইয়া হিয়া খান। তিনি প্রতিশ্রæতি দেন বাঙ্গলীদের সকল দাবী পর্যায়ক্রমে মানা হবে। এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সকল দাবীর প্রতিফলন ঘটাবে। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে সমগ্র পাকিস্তানে সংসদ নির্বাচন দিলে বাঙ্গালীদের দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙ্গালীদের এই ঐক্যবদ্ধতা ও বিজয় দেখে শাসক গুষ্ঠি আতংকিত হয়ে যায়। তাই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে নানাহ টাল বাহানা আরম্ভ করে। বাঙ্গালীরাও তা বুঝতে পেরে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেন ৫২ সালে রক্ত দিয়েছি ভাষার জন্য, এবার রক্ত দিব স্বাধীনতার জন্য। ২৫শে মার্চ ১৯৭১ রাতের আধারে পাক বাহিনী নির¯্র, ঘুমন্ত বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, আরম্ভ করে হত্যা, অগ্নি সংযোগ ও নারী নির্যাতন। বাঙ্গালীরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলে । দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ি যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালী প্রাণ উৎসর্গ করে, দু-লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্ব-ভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় ভাষা আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎস।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ, পাকিস্তানের ৯৩ হাজার দক্ষ সৈনিকের আত্মসমর্পণ বিশে^ আলোরণের সৃষ্টি করেছে। তার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সর্ব উচ্চ আদালত এর বিচারকদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন হয়। কমিশনের রির্পোটের প্রথম শর্ত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালীর ন্যায্য দাবী ছিল। কিন্তু ছাত্রদের বুকে গুলি চালানো মহা- মহাভুল। আর রির্পোট এর মুল বক্তব্য হলো নিম্মরূপ———
“আল্লাহর লাঠি নিরবে চলে // আল্লাহর বিচার বিলম্বে হয়, কিন্তু সঠিক ও নির্ভূল।
অত্যাচারি, ঘাতক, নারী নির্যাতন কারিদের পরিণাম খরাপ হয়।
যেমন তাদের উত্থান হয় বিস্ময় কর। // তেমনি তাদের পতন ও হয় ভয়ংকর।
২১ শে ফেব্রæয়ারি থেকে বাঙ্গালী জাতি আত্ম মর্যাদার চেতনা লাভ করছে। তাদের দাবী ছিল সঠিক তারা কখনো অযৌক্তিক দাবী করে নাই। তজ্জন্যই আজ সমগ্র বিশ্ব ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রæয়ারিকে স্মরণ করে আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস হিসেবে গ্রহন করেছে। তবু দুঃখ থেকে যায় ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকরা কাজের সময় নির্ধারণের দাবীতে আন্দোলন করলে পুলিশের গুলিতে কিছু সংখ্যক শ্রমিক নিহত হয়। তার চার বৎসর পর অর্থাৎ ১৮৯০ সাল থেেেক সমগ্র বিশে^ ১লা- ‘মে’ কে ঐতিহাসিক মে দিবস হিসেবে আর্ন্তজাতিক ভাবে পালন করে আসছে।
কিন্তু বাঙ্গালীর বুকের রক্তে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারি যে “ভাষা বৃক্ষটি” রূপণ করা হয়েছিল তা দীর্ঘ ৪ যুগ অর্থাৎ ৪৮ বৎসর পর ২০০০ সালে ফুলে ফলে বিকশিত হয়ে উঠেছেএবং বিশ্ববাসীর দৃষ্টি গোচর হয়েছে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বিকৃতি পেয়েছে। ইহাই বাঙালী জাতির চরম ও পরম পাওয়া।
ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালী জাতি আত্মমর্যাদার চেতনা লাভ করেছিল, লাভ করেছিল মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের প্রেরণা এবং অনুভব করেছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজন। আজো একুশের চেতনার সমাপ্তি ঘটেনি। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু আমাদের পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি, আসেনি সামাজিক সাম্য। আজো আমরা সুখী সমৃদ্ধ এবং সুন্দর সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। প্রতিবছর একুশের চেতনা আমাদেরকে দারিদ্র মুক্ত, অভাবহীন, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের প্রেরণা দিয়ে যায়।
একবিংশ শতাব্দির সূচনা লগ্নে সমগ্র বিশ্বের দেশে দেশে রাষ্ট্রভাষা শহীদদের স্মরণে এক সংগে গেয়ে উঠে———-
মৃত্যু এরা জয় করেছে, কান্না কিসের–?
আপ্ জম্জম্ আনলো এরা – আপনি পিয়ে কলসী বিষের, // কান্না কিসের–?
বেশ করেছে দেশ বাঁচাতে ভাষার জন্যে আপনারি জান শেষ করেছে।
শহীদ ওরা- ই শহীদ।
২১শে ফেব্রæয়ারি পৃথিবীর ইতিহাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎস ও বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস।
সংবাদ শিরোনাম :
ভাষা আন্দোলন- ই স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎস-মিয়া মোঃ সা’দী
- দৈনিক আলোর জগত ডেস্ক :
- আপডেট টাইম : ০৮:৩৪:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১
- ৩৬৬ বার পড়া হয়েছে
Tag :