>

বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩, ০৭:১৭ অপরাহ্ন

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা কুমিল্লার লালমাই পাহাড়

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা কুমিল্লার লালমাই পাহাড়

ফিচার ডেস্ক :  কুমিল্লার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক লালমাই পাহাড়। কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ ও বরুড়া উপজেলা জুড়ে এই লালমাই পাহাড়টি অবস্থিত। এটি উত্তর-দক্ষিণে ১১ মাইল লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২ মাইল চওড়া। এ পাহাড়ের মাটি লাল হওয়ায় এর নাম লালমাই। এ পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৫০ ফুট। কথিত আছে, রাম-রাবণের যুদ্ধে রামের ছোট ভাই লক্ষণ গুরুতর আহত হলে বৈদ্যের নির্দেশ অনুযায়ী বৈশল্যকরণী পাতার রস ক্ষতস্থানে লাগালে লক্ষণ ভালো হয়ে যাবে বলা হয়। কিন্তু বেচারা হনুমান গাছ চিনতে না পেরে হিমালয় পর্বত পুরোটা তুলে হাতে করে নিয়ে আসে। চিকিৎসার পর আবার পর্বতটা যথাস্থানে নিয়ে যেতে রওয়াানা দেয় হনুমান। কিন্তু পথে পর্বতের কিছু অংশ ভেঙ্গে কুমিল্লা সংলগ্ন লমলম সাগরে পড়ে যায়। আর তখন থেকেই এ স্থানের নাম রাখা হয় লালমাই। এছাড়া শোনা যায় এক রাজার নাকি দুই মেয়ে ছিল। একজনের নাম ছিল লালমতি অন্যজনের নাম ময়নামতি। তাদের নামানুসারেই নাকি এই লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে।আমি অগ্রগামী নামে একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রাজু ভাই। আমি প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা আসতাম। রাজু ভাই সিদ্ধন্ত নিলেন সংগঠনের সবাই মিলে পিকনিক করা। টিংকু ভাইকে দায়িত্ব দেওয়া হলো স্থান ঠিক করার জন্য। তিনি কুমিল্লার বার্ডস। যেই কথা সেই কাজ। আমরা সবাই একটা বাসে যাত্র শুরু করি। সকালের নাস্তা বাসেই সারা হয়। এরপর চলে গানের আয়োজন। কিন্তু বাসে কোন ক্যাসেট নাই। তাই আমি উদ্যোগী হয়ে সবার থেকে চাদা তুলে ক্যাসেট কিনি। ক্যাসেট বাজাতে গিয়ে আরেক বিপত্তি, বাসের ক্যাসেট প্লেয়ার ভাল না। তাই গান শুনা আর হলো না। নিজেরাই চিল্লাচিল্লি করে যা সম্ভব তাই চালিয়ে নেওয়া। আমরা দুপুরের কিছু আগে বার্ডেসে পৌছাই। এরপর যে যার মতো করে বা দল বেধে ঘুরে বেড়ানো।আমরা এই পাহাড় থেকে ওই পাহাড়ে যাচ্ছি। সবার নাম আমার মনে নাই। তবে মাসুদ ও হূদয়ের সাথে আমার এখনো যোগাযোগ আছে। আমরা এক সাথে যখন এই পাহাড় সেই পাহাড়ে যাচ্ছি, তখন আমাদের সাথে দুই জন মেয়ে ছিল। যারা আপন দুই বোন। এক সময় আমরা পাহাড়ের চুড়ায় দাড়িয়ে গল্প করছি, এমন সময় ওই দুই বোনের এক বোন হাটতে হাটতে নিচের দিকে যায়। আমাদের সাথে সাব্বির ছিল। ও তখন অনেক স্বাস্থবান এবং লম্বা ছিল। মেয়েটা যখন উপরে উঠতে পারছিল না, তখন তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ যাচ্ছে না। এমন কি সাব্বিরও না। তখন আমি তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। আমি যখন তার হাত ধরে উপরে উঠে আসছি। প্রায় কাছা কাছি চলে আসার পর মেয়েটা পা পিছলে পড়ে যায়, তার টানে আমিও পড়ে যাই। দুজনে গড়াগড়ি খেয়ে প্রায় নিচে চলে যাই। আমাদের এমন বিপদ দেখে উপর থেকে সবাই মজা নিচ্ছে। নিচে আবার শিয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে। ওই অবস্থায় পড়ি মরি করে আবারো দুজনে উপরে চলে আসি। কে জেনো বলেছিল, সিনেমার দৃশ্য দেখলাম।বার্ডসে আমরা দুপুরের খাবার খাই। এখানে খুবই গুছানো এবং নিয়মত্রান্ত্রিক ভাবে খাবার পরিবেশন করা হয়। বুফে খাবার নিতে হয়। জনপ্রতি যা বরাদ্দকৃত খাবার যদি কেউ না খায় বা বেশি হয় তাহলে তা ফেরত নেওয়া হয় না। ভাল খাবারও ফেলে দেওয়া হয়। আমি একজন বলেছিলাম, ভালখাবার ফেলে দিচ্ছেন কেনো? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, বিক্রি করা খাবার ফেরত নেওয়া হয় না।যাই হউক, আমরা এবার একটু সৌন্দর্য্য নিয়ে কথা বলি। লালমাই পাহাড়ের যে সৌন্দর্য্যটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে তা হল এখানকার লাল মাটি। এছাড়াও পর্বতের সমস্ত মাথা জুড়ে কোথাও ঘন গাছপালা কোথাও আবার ন্যাড়া অংশ যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়ও লালমাই পাহাড়ে রয়েছে অপার সমৃদ্ধির হাতছানি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটির গঠন অনুযায়ী প্রাচীন এ জনপদে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে পারে তেল গ্যাসের মতো খনিজ সম্পদ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শালবন বৌদ্ধ বিহার। এছাড়া পাহাড়ের এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক স্থাপনা।লালমাই পাহাড়েরই একটি স্থানের নাম সালমানপুর। এই সালমানপুরেই ২০০৬ সালে চালু হয় ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। একই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সিসিএন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও। এখানে রয়েছে শালবন বিহার। পূর্বে এই প্রত্নস্থানটি ‘শালবন রাজাবাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। এর আসল নাম ‘ভবদেব মহাবিহার’। এই বিহারটি খননে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ প্রত্নসম্পদ, যা এখন ময়নামতি জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। রয়েছে ময়নামতি বৌদ্ধবিহার। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তি রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন স্পটের মধ্যে শালবন বিহার ও বৌদ্ধ বিহার অন্যতম। ৩ বৌদ্ধ বিহার থেকে ৩ মাইল উত্তরে দেখতে পাওয়া যায় কুটিলামুড়া ও রূপবান মুড়া। এরও উত্তর-পশ্চিমে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত চারপত্র মুড়া। এখানে বনবিভাগ ২টি পিকনিক স্পট চালু করেছে।এখানেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)। বার্ডের ভিতরের নয়নাভিরাম রাস্তা দিয়ে সামনে এগুলেই দেখতে পাওয়া যাবে নীলাচল পাহাড়। দু’পাহাড়ের মাঝখানে দেখতে পাওয়া যাবে অনিন্দ্যসুন্দর বনকুটির। চন্ডী মন্দিরদ্বয়ও অবস্থিত এখানে। আর এই চন্ডি মন্দিরদ্বয়ের নামানুসারে এলাকাটি চন্ডিমুড়া নামে বেশ পরিচিত।লালমাইয়ের পাশেই রয়েছে নূরজাহান ইকো পার্ক, রাজেশপুর ফরেস্ট, সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভাই শাহজাদা সুজার নাম অনুসারে নির্মিত শাহ সুজা বাদশাহ্ মসজিদ, রাজা ধর্মমানিক্যের খননকৃত ২৩.১৮ একর আয়তনের ধর্মসাগর, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতবিজড়িত ময়নামতি ওয়ার সেমিট্রি, রাণীর বাংলো, ত্রিশ আউলিয়ার মাজার, নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃত নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি, পাশেই রয়েছে কুমিল্লার সুখ-দুঃখ গাঁথা গোমতী নদী। এছাড়াও রয়েছে কুমিল্লা পৌর শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা ও ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ।যে কোন দেশ ও জাতির গৌরবময় পরিচয় চোখের সামনে বাস্তব করে তোলে কালের সাক্ষী হয়ে নীরবে জেগে থাকা প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব ও প্রত্নস্থাপনা। বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলে এখন শুরু করতে হয় খৃষ্টপূর্ব ৫ থেকে ৬ শতক আর ইতিহাস পরিবর্তনে যে সকল প্রত্নস্থান কলের সাক্ষী হয়ে দাড়িঁয়ে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি প্রত্নস্থান। আর এই গৌরবময় জনপদটির নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে লালমাই পাহাড়, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, কোটিলা মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, চন্ডি মন্দিরসহ ৫৪টি টিবি ও বৌদ্ধ বিহার।১৯৮৯ সালের এপ্রিলে ও ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে লালমাই পাহাড়ে কয়েকদফা প্রত্নতাত্তিক অনুসন্ধান চালানো হয়। এই অনুসন্ধানে, এখানে ১১টি প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।

এগুলো হচ্ছে লালমাই-১, লালমাই-২, লিলা মুড়া ও টক্কা মুড়া,মহরম আলীর বাড়ী, টিপরা মুড়া, আাঁঁদার মুড়া, মাইদার মুড়া, মেম্বোরের খিল, মেহের কুরের মুড়া, টক্কা মুড়া-২ ও সরদারের পাহাড়ে এই প্রত্নক্ষেত্র প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলি কাঠের ফসিল। এগুলো হচ্ছে কাটারি (৩টি), হাত কুঠার (৬টি), মাংস কাটার ভারি ছুরি (৪টি), কাঠ চাঁছার যন্ত্র (১২টি), বাটালি ১টি, ছুরি ২টি, ছুরির ফলা (৪৬টি), চাঁছলি (৯৮টি), সূচ্যগ্র যন্ত্র (৫০টি), ছিদ্র করার যন্ত্র (৯টি), খোদাই করার যন্ত্র (৪টি), ব্যবহূত পাতলা কাঠের টুকরা (১২৪টি), কাঠের পাতলা টুকরো (৩৩টি), পাতলা ফালি (৪৩টি) এবং ২০০৪ সালের এক অনুসন্ধানে ১৭১ টি প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির হাতিয়ার পাওয়া গেছে। যা ঢাকা-ময়নামতি জাদুঘর ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিজস্ব সংগ্রহে রয়েছে।

লালমাই পাহাড়ে এতগুলো হাতিয়ার প্রাপ্তি দেখে ধারণা করা যায় যে, প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এই অঞ্চলে হাতিয়ার তৈরির কারখানা ছিল। আর তা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে এই দেশের ইতিহাস লেখতে হবে আরো ৩,৫০০ বছর পূর্বে থেকে।ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার জন্য যে কেউ রেলপথ অথবা সড়কপথ বেছে নিতে পারেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে অতি সহজে সরাসরি চলে যাওয়া যায়। অথবা সায়েদাবাদ থেকে বাসে করেও যাওয়া যায়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © 2018 Dainikalorjagat.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com