রমজান মাসের তৃতীয় দশকের বিদায়কালীন শুক্রবার তথা শেষ জুমার দিন মুসলিম বিশ্বে ‘জুমাতুল বিদা’ নামে পরিচিত‘জুমুআ’ আরবি শব্দটির বাংলা অর্থ শুক্রবার আর ‘বিদা’ অর্থ শেষ। জুমাতুল বিদা অর্থ শেষ শুক্রবার। মাহে রমজানের শেষ জুমার দিনটি আমাদের সমাজে জুমাতুল বিদা নামে পরিচিত। যদিও পরিভাষাটি কোরআন বা হাদিসের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না। তারপরও মোবারক মাস রমজানের শেষ জুমার দিন হিসেবে এর গুরুত্ব কম নয়। রমজান আর জুমা একত্রে মিলিত হয়ে দিনটিকে করে তুলেছে সীমাহীন মহিমাময়।উম্মতে মোহাম্মাদীর জন্য মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে বছর ঘুরে আসা মাহে রমজান আর তার সঙ্গে যুক্ত সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন ইআওমুল জুমা। তাই জুমাতুল বিদায় প্রত্যেকটা মুমিন মুসলমানের বিশেষ তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।মসজিদে জামাতের সঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করা এবং বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা ও নিজের আত্মার আকুতি দয়াময় প্রভুর দরবারে পেশ করাই যেন এ দিনে সব মুসলমানের পরম আগ্রহের বিষয়।★জুমাতুল বিদার মহত্ত্ব: দু’টি কারণে জুমাতুল বিদা অত্যন্ত মহিমাময়।* মাহে রমজানের কারণে: রমজান মাস সীমাহীন ফজিলতের মাস এবং এটি উম্মতে মোহাম্মাদীর জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ উপহার স্বরূপ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের রব বলেছেন, বনি আদমের প্রত্যেকটি নেক-আমলের সওয়াব দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত দেওয়া হয় শুধু রোজা ছাড়া।কেননা রোজা শুধুই আমার জন্য, আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো।আর নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশ্ক আম্বারের চেয়েও বেশি প্রিয়। তোমাদের কারো রোজা থাকা অবস্থায় যদি কেউ তার সঙ্গে জাহেলের মতো আচরণ করে তাহলে সে বলে দেবে, আমি একজন রোজাদার। (সহিহ আল-বোখারি, হাদিস: ৫৯২৭, সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৫১, মুসান্নেফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস: ৮৮৯৪, মুসনাদে আহমাদ: ৯৭১৪) আর জুমার দিনের মাহাত্ম্য সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সূর্যদয়ের মাধ্যমে যে দিনগুলো হয় তার মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুমার দিন।
এই দিনে হজরত আদমকে (আ.)সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এই দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল এবং এই দিনেই তাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। আর এদিনের মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যখন কোনো মুসলমান নামাজরত অবস্থায় দোয়া করলে অবশ্যই তার দোয়া কবুল করা হয়। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৪৯১) রমজান মাসে রোজা অবস্থায় জুমার দিনের নিশ্চিত দোয়া কবুলের শেষ সুযোগ হিসেবে জুমাতুল বিদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।* করণীয়: জুমার দিনের কিছু সুন্নত আমল রয়েছে। যেমন (১) সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করতে হবে (২) নতুন বা উত্তম জামা কাপড় পরতে হবে (৩) আতর তথা সুগন্ধি ব্যবহার করতে হবে (৪) হেঁটে মসজিদে যেতে হবে (৫) আগে আগে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে (৬) ইমামের কাছাকাছি জায়গায় বসতে হবে। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে করতে হবে (৭) ইমামের খুৎবা মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে (৮) বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করতে হবে (৯) কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না, কোনো অনর্থক কাজ করা যাবে না। হজরত আওস ইবনে আওস আস-সাকাফি (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিনে ভালো করে গোসল করবে এবং আগে আগে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাবে এবং ইমামের কাছাকাছি বসে খুৎবা মনোযোগ সহকারে শুনবে আর কোনো রকম অনর্থক কাজ করবে না তাকে তার প্রতিটি কদমের বিনিময়ে লাগাতার এক বছর নামাজ ও রোজার সওয়াব দান করা হবে। (সুনানে ইবনে মাযা, হাদিস: ১০৮৭, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৩৪৫, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদিস: ১৭০৩, সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ১৩৮৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৬১৭৬, সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ২৭৮১)পরিশেষে , ইসলাম ধর্মে রমজানের শেষ জুমা হিসেবে মুসলিম উম্মাহর কাছে দিনটির বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। জুমাতুল বিদার ফজিলত অনেক বেশি। রমজান মাসের সর্বোত্তম রাত লাইলাতুল কদর, আর সর্বোত্তম দিন জুমাতুল বিদা।
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রমজান মাসের শেষ শুক্রবার হজরত সুলায়মান (আ.) জেরুজালেম নগরী প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলা ‘মসজিদ আল-আকসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ জন্য প্রতিবছর সারা বিশ্বের মুসলমানরা রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘আল কুদস’ দিবস হিসেবে পালন করেন।মোটকথা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ দিনের সাথে জড়িত। ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম’- উম্মতে মুহাম্মদির শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা সংবলিত সূরা মায়েদার এ তিন নম্বর আয়াতটি নাজিল হয়েছিল ৯ জিলহজ জুমার দিনে।মোট কথা সাধারণভাবে জুমার দিনের এসব গুরুত্ব মাহাত্ম্য রয়েছে। রমজান মাসের কারণে এ মাহাত্ম্য অনেকগুণ বেড়ে যায়- যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর রমজানের শেষভাগের প্রতিটি দিনই স্মরণ করিয়ে দেয় বহুগুণ ছওয়াব লাভের সুযোগ চলে যাচ্ছে বলে।শেষ জুমার দিনটি যেন আরো জোরালো ভাষায় উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে মুমিন বান্দাদের তওবা ইস্তেগফারে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য।সিয়াম সাধনার মাস সফলভাবে সম্পন্ন করার শেষ প্রান্তে উপনীত হওয়াও একটি শুভ আলামত। তাই আল্লাহ তায়ালার অপার রহমত ও অনুগ্রহের অধিকারী হওয়ার এবং পাপরাশি থেকে পাকসাফ হয়ে ঈদের আনন্দ ভোগের সুসংবাদ ঘোষণা হতে থাকে রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে। এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনের মূল্যায়ন করা ও সদ্ব্যবহার করা রোজাদারদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
লেখক, এম এ কামিল হাদিস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
কো-চেয়ারম্যান, হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ইমেইল, drmazed689@gmail.com