নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদে সাবেক এক অতিরিক্ত সচিবকে সম্প্রতি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তাঁর মতো অন্তত সাতজন সাবেক অতিরিক্ত সচিবকে চলতি বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদের প্রায় তিন গুণ কর্মকর্তা প্রশাসনে কর্মরত। উপযুক্ত দপ্তর না পেয়ে অনেকে ইন-সিটু বা আগের পদেই কাজ করছেন। একইভাবে চলতি বছর অবসরে যাওয়া ১৯ জন সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে। এ মুহূর্তে প্রশাসনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তাসহ অন্তত ২১ সচিব চুক্তিতে কর্মরত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবসরে যাচ্ছেন অন্তত ৮ সচিব। তাঁদের মধ্যেও দু-তিনজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন। অথচ যোগ্যতা অর্জন করে সচিব হওয়ার অপেক্ষায় আছেন বিসিএস ১১, ১৩ ও ১৫তম ব্যাচের কয়েক শ কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পুরোনো কর্মকর্তাদের ওপরই সরকারের আস্থা বেশি। ফলে জনপ্রশাসনে খুব শিগগির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থেকে মুক্তি মিলছে না। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠানে এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অবৈধ নয়। এটা আগেও ছিল এখনো আছে। তিনি বলেছেন, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ও কারিগরি পদে যোগ্য ব্যক্তি না পাওয়া গেলে জনস্বার্থেই চুক্তিতে নিয়োগ দিতে হয়। প্রশাসনিক সুবিধার জন্যই সরকারকে এটা করতে হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্যমতে, প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ ৮৮ জন সচিব আছেন। তাঁদের মধ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অন্তত ২১ জনই চুক্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে অন্তত ১০০ কর্মকর্তা আছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর দেশে যখন সরকারি কর্মকর্তার সংকট ছিল, তখন ১৯৭৪ সালের সরকারি কর্মচারী অবসর আইনের আওতায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিযোগ, সেই পরিস্থিতি এখন না থাকলেও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ১ মার্চ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চিঠি দিয়েছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা করারও তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চলছেই।
চুক্তিতে আছেন যাঁরা: বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছাড়াও চুক্তিতে আছেন বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে ড. আহমদ কায়কাউস, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে শ্যাম সুন্দর সিকদার এবং রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব পদে সম্পদ বড়ুয়া। বিসিএস ১৯৮৫ ব্যাচের মো. আখতার হোসেন আছেন এসডিজির মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্বে এবং মাসুদ বিন মোমেন আছেন পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্বে। চুক্তিতে আরও আছেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আবদুস সালাম, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফিজুর রহমান, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে সংযুক্ত সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম খান ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। এ ছাড়া পূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, বেসামরিক বিমান ও পর্যটনসচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, ইরাকে রাষ্ট্রদূত ফজলুল বারী, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ এবং রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়াও চুক্তিতে আছেন।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে চুক্তিতে আছেন বেশ কয়েকজন সাবেক সচিব। তাঁদের মধ্যে আছেন ফয়েজ আহম্মদ, কে এম আলী আজম, ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী, হেলালুদ্দিন আহমদ, খলিলুর রহমান, এস এম গোলাম ফারুক, এন সিদ্দিকা খানম প্রমুখ। এ ছাড়া কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন পদে চুক্তিতে আছেন সাবেক সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক খাদ্যসচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ, সাবেক আইজি জাভেদ পাটোয়ারী, সাব্বির বিন শামস, ড. খলিলুর রহমান প্রমুখ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস এবং পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও চুক্তিতে আছেন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কর্মদক্ষতা কমে যায়: তবে প্রশাসনের বেশির ভাগ নিয়মিত কর্মকর্তা নতুন করে আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান না। একই রকম অভিমত প্রশাসন বিশেষজ্ঞদেরও। তাঁরা বলছেন, কোনো একটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে চার-পাঁচজন কর্মকর্তা বঞ্চিত হন। এতে প্রশাসনে হতাশা সৃষ্টির পাশাপাশি চেইন অব কমান্ড বিঘ্নিত হয়।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া বলেন, ‘সাধারণভাবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। এতে প্রশাসনের নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। কর্মদক্ষতা কমে যায়, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়। তবে কিছু কারিগরি পদে যোগ্য কর্মকর্তা না পাওয়া গেলে সরকার চাইলে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতেই পারে। এটা অতীতেও ছিল।’