ঢাকা ০৩:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম :
Logo অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা হতে ০৪ জন পরিবহন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০। Logo ফরিদপুর জেলার মধুখালিতে “শ্যালিকার সঙ্গে পরকীয়ার জেরে দুলাভাইকে হত্যা” শীর্ষক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার পলাতক আসামি শরিফুল শেখ ও তথি বেগম’কে ফরিদপুরের কোতোয়ালি এলাকা হতে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০। Logo মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগীবাড়ী এলাকা হতে ২৩.৫ কেজি গাঁজাসহ ০১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০ Logo গ্রাম পুলিশ সদস্যকে ধর্ষণের অভিযোগে এক ইউপি চেয়ারম্যান ও সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা Logo আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস রিপোর্টার্স ফোরামের শ্রদ্ধা

চাঁপাইনবাবগঞ্জে চিকিৎসাসেবার নামে বাণিজ্য, ৮৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই অবৈধ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে বাণিজ্য। রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সরকারি স্বাস্থ্যনীতির তোয়াক্কা না করে এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নামিদামি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিত্র একই।
জানা গেছে, শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে মাত্র ২০টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে। এছাড়া চাহিদামতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করায় সিভিল সার্জনকে আরও ১৮ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর বাইরে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চলছে অবৈধভাবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশির ভাগ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা প্রদানে মানা হচ্ছে না সরকারি নীতিমালা। বালাই নেই সেবার মান বা নীতিনৈতিকতার। তবে স্থানীয় স্বাস্থ্যবিভাগ বলছে, সবগুলো প্রতিষ্ঠানই লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিবন্ধিত প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছাড়াও বেশ কিছু অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জেলাজুড়ে। এদের বেশির ভাগই নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে চালাচ্ছে শুধু ব্যবসা। এ ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাবে অবৈধ ও অনৈতিক তৎপরতায় টিকে আছে। সঙ্গে চিকিৎসকদের সরাসরি প্রশ্রয়, সহযোগিতা ও তদবির, ওই অনিয়মকে আরো ফুলেফেঁপে উঠতে সহায়তা করছে। ক্ষেত্রবিশেষে কর্তৃপক্ষ জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে চিকিৎসকদের ভেতর থেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধার সৃষ্টি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানা থেকে শুরু করে পরিচালনার ক্ষেত্রেও কোনো না কোনো পর্যায়ে চিকিৎসকদের সংশ্লিষ্টতাই বেশি। খুব কমসংখ্যক হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, যার মালিকানা, পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে চিকিৎসক নেই। তবে ওই সব প্রতিষ্ঠানেও চিকিৎসকরা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন। ফলে তাদেরও নৈতিক দায় রয়েছে তার কর্মস্থলে অন্যায়-অনিয়মের বিষয়ে নজরদারির।
এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় কক্ষ নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নেই ডিউটি ডাক্তার, ডিপোমা নার্স, টেকনিশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল। ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশও নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। তার পরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধন পেয়েছে, নবায়নও হচ্ছে। আর এর সুবাদে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করছে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ রয়েছে- চিকিৎসকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে চিকিৎসক সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। চিকিৎসক তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। চিকিৎসকরা এখন সামান্য জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকলেও ক্লিনিকে ভর্তি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়েন তারা। সুযোগ থাকলে অপারেশনের মুখোমুখিও করিয়ে দেয়া হয় রোগীকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি করাতে পারলেই কমিশন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পকেটে যায়। প্রতি ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আলাদা কমিশন নির্ধারণ করা আছে। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ-সুবিধাও নেন চিকিৎসক।
অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করেই অস্ত্রোপচার ও স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন প্রতিষ্ঠান মালিকরা। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানে রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ফি আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান ভেদে আদায় করা হচ্ছে একেক ধরনের ফি। এতে চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন রোগী ও স্বজনরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে ৮০-৬০০, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজির জন্য ১৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০, বায়োকেমিস্ট্রির জন্য ১২০-৮০০, হিস্ট্রোপ্যাথলজির জন্য ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০, ড্রাগ অ্যাবিউজের জন্য ৫৫০, থেরাপিউটিক ড্রাগের জন্য ৫০০ ও ভাইরোলজির জন্য ২০০ থেকে ২০০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ফি গ্রহণে এ নীতিমালা মানা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি ক্লিনিকের নিবন্ধন পেতে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, ডিপোমা নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনারসহ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকা আবশ্যক। সূত্র মতে, ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটি রুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াস রুম, ইনস্ট্রুমেন্ট রুম, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনা কক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম, ভাণ্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তত ১৩টি রুম থাকতে হবে। কিন্তু এসব নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে বাসাবাড়িতে ক্লিনিক গড়ে তুলে চিকিৎসার নামে প্রতারণা চলছে হরদম।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরেই একের পর এক বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠছে। মোট ১৩২টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ ক্লিনিক ও ৮২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সদর উপজেলায় বেসরকারি ক্লিনিক ১৪ ও ডায়াগনস্টিক রয়েছে ৩৪টি।
এছাড়া শিবগঞ্জে ক্লিনিক ১৮টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২২টি, নাচোলে ক্লিনিক ৪টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৫টি, গোমস্তাপুরে ক্লিনিক ১৩টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৮টি, ভোলাহাটে ক্লি¬নিক একটি ও ৩টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সিভিল সার্জনের তালিকার বাইরে শহর ও গ্রামে বেশ কয়েটি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যসেবার ব্যবসা করছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র আরও জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের কাছে লাইসেন্স নবায়নের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেছেন ১৩২ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে নবায়ন হয়েছে মাত্র ২০টি প্রতিষ্ঠানের। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাহিদামতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করায় ১৮ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, লাইসেন্স না থাকা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকাভুক্তির কাজ চলছে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বেশ কয়েকটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্যনীতি উপেক্ষা করে চিকিৎসাসেবার নামে যারা বাণিজ্য করছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

অবৈধভাবে চাঁদা উত্তোলন করাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা হতে ০৪ জন পরিবহন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে চিকিৎসাসেবার নামে বাণিজ্য, ৮৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই অবৈধ

আপডেট টাইম : ০৪:২২:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে বাণিজ্য। রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সরকারি স্বাস্থ্যনীতির তোয়াক্কা না করে এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নামিদামি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিত্র একই।
জানা গেছে, শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে মাত্র ২০টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে। এছাড়া চাহিদামতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করায় সিভিল সার্জনকে আরও ১৮ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর বাইরে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চলছে অবৈধভাবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশির ভাগ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা প্রদানে মানা হচ্ছে না সরকারি নীতিমালা। বালাই নেই সেবার মান বা নীতিনৈতিকতার। তবে স্থানীয় স্বাস্থ্যবিভাগ বলছে, সবগুলো প্রতিষ্ঠানই লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিবন্ধিত প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছাড়াও বেশ কিছু অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জেলাজুড়ে। এদের বেশির ভাগই নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে চালাচ্ছে শুধু ব্যবসা। এ ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাবে অবৈধ ও অনৈতিক তৎপরতায় টিকে আছে। সঙ্গে চিকিৎসকদের সরাসরি প্রশ্রয়, সহযোগিতা ও তদবির, ওই অনিয়মকে আরো ফুলেফেঁপে উঠতে সহায়তা করছে। ক্ষেত্রবিশেষে কর্তৃপক্ষ জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে চিকিৎসকদের ভেতর থেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধার সৃষ্টি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানা থেকে শুরু করে পরিচালনার ক্ষেত্রেও কোনো না কোনো পর্যায়ে চিকিৎসকদের সংশ্লিষ্টতাই বেশি। খুব কমসংখ্যক হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, যার মালিকানা, পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে চিকিৎসক নেই। তবে ওই সব প্রতিষ্ঠানেও চিকিৎসকরা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন। ফলে তাদেরও নৈতিক দায় রয়েছে তার কর্মস্থলে অন্যায়-অনিয়মের বিষয়ে নজরদারির।
এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় কক্ষ নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নেই ডিউটি ডাক্তার, ডিপোমা নার্স, টেকনিশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল। ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশও নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। তার পরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধন পেয়েছে, নবায়নও হচ্ছে। আর এর সুবাদে উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করছে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ রয়েছে- চিকিৎসকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে চিকিৎসক সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। চিকিৎসক তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। চিকিৎসকরা এখন সামান্য জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকলেও ক্লিনিকে ভর্তি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়েন তারা। সুযোগ থাকলে অপারেশনের মুখোমুখিও করিয়ে দেয়া হয় রোগীকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি করাতে পারলেই কমিশন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পকেটে যায়। প্রতি ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আলাদা কমিশন নির্ধারণ করা আছে। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ-সুবিধাও নেন চিকিৎসক।
অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করেই অস্ত্রোপচার ও স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন প্রতিষ্ঠান মালিকরা। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানে রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ফি আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান ভেদে আদায় করা হচ্ছে একেক ধরনের ফি। এতে চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন রোগী ও স্বজনরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে ৮০-৬০০, মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজির জন্য ১৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০, বায়োকেমিস্ট্রির জন্য ১২০-৮০০, হিস্ট্রোপ্যাথলজির জন্য ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০, ড্রাগ অ্যাবিউজের জন্য ৫৫০, থেরাপিউটিক ড্রাগের জন্য ৫০০ ও ভাইরোলজির জন্য ২০০ থেকে ২০০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ফি গ্রহণে এ নীতিমালা মানা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি ক্লিনিকের নিবন্ধন পেতে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, ডিপোমা নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনারসহ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকা আবশ্যক। সূত্র মতে, ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটি রুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াস রুম, ইনস্ট্রুমেন্ট রুম, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনা কক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম, ভাণ্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তত ১৩টি রুম থাকতে হবে। কিন্তু এসব নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে বাসাবাড়িতে ক্লিনিক গড়ে তুলে চিকিৎসার নামে প্রতারণা চলছে হরদম।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরেই একের পর এক বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠছে। মোট ১৩২টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ ক্লিনিক ও ৮২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সদর উপজেলায় বেসরকারি ক্লিনিক ১৪ ও ডায়াগনস্টিক রয়েছে ৩৪টি।
এছাড়া শিবগঞ্জে ক্লিনিক ১৮টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ২২টি, নাচোলে ক্লিনিক ৪টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৫টি, গোমস্তাপুরে ক্লিনিক ১৩টি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১৮টি, ভোলাহাটে ক্লি¬নিক একটি ও ৩টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। সিভিল সার্জনের তালিকার বাইরে শহর ও গ্রামে বেশ কয়েটি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যসেবার ব্যবসা করছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র আরও জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের কাছে লাইসেন্স নবায়নের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেছেন ১৩২ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে নবায়ন হয়েছে মাত্র ২০টি প্রতিষ্ঠানের। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাহিদামতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করায় ১৮ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, লাইসেন্স না থাকা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকাভুক্তির কাজ চলছে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বেশ কয়েকটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্যনীতি উপেক্ষা করে চিকিৎসাসেবার নামে যারা বাণিজ্য করছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।