ডা: মো: হাফিজুর রহমান (পান্না), রাজশাহী ব্যুরো :
রাজশাহী অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ কমছেই না। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আক্রান্তদের নেয়া হচ্ছে হাসপাতালেও। কেউ অ্যাম্বুলেন্স, কেউ ভ্যান কেউবা আবার অটোরিকশায় রোগী নিয়ে ছুটছেন। আর তখনই আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তাছাড়া হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর পরও এখন লাশ দাফন-সৎকার করা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই। করোনাকালের শুরুতে প্রতিটি লাশ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন করা হলেও এখন তাঁদের ডাক পড়ে না। সচেতন দু’একজন ব্যক্তি তাঁর মৃত স্বজনকে দাফনের জন্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে ডেকে থাকেন। অথচ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে এখন প্রতিদিনই গড়ে ১০ জন রোগী মারা যাচ্ছেন।
আর শুধু রাজশাহী থেকেই প্রতিদিন অন্তত ভর্তি হচ্ছেন নতুন ১৫ জন রোগী। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মোট ২৫৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে রাজশাহীর ১২৭ জনেরই বাড়ি রাজশাহী। এছাড়া ১০২ জনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীর ১৬ জন করোনা রোগীকে হাসপাতালে করা হয়েছে। সোমবার রাজশাহীর ৩৮৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৭৯ জনেরই করোনা পজিটিভ রিপোর্ট হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রাজশাহীতে সংক্রমণের হার ৪৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
রাজশাহীর সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মঙ্গলবার শুধু রাজশাহী মহানগরীতেই ২ হাজার ২৫৪ জন করোনা রোগী ছিলেন। তাঁরা বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন। অসুস্থতা বাড়লে এরা হাসপাতালেই যাবেন। রাজশাহী মহানগরীর রামচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দা জুলফিকার আলীকে (৫০) মঙ্গলবার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
জুলফিকার আলী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। বাড়িতে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সের জন্যও অপেক্ষা করেননি স্বজনেরা। একটি অটোরিকশাতে তুলেই তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। জরুরি বিভাগের সামনে রোগীকে হাসপাতালের ট্রলিতে তুলে নেন স্বজনেরা। তারপর ভাড়ার টাকা নিয়ে চলে যান অটোরিকশার চালক। ওই চালককে তাঁর অটোরিকশায় কোন জীবাণুনাশক স্প্রে করতে দেখা যায়নি। ফলে তাঁর অটোরিকশা থেকেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে।
রামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: সাইফুল ফেরদৌস জানান, প্রতিদিন এখন রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই সবচেয়ে বেশি রোগী আসছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোগীগুলোর সবাইকে অ্যাম্বুলেন্সে করেই আনা হচ্ছে। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা থেকে যেসব রোগী আসছেন তাঁদেরও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে আনা হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহী শহরের অনেক রোগীই অ্যাম্বুলেন্সে আসছেন না। হাসপাতাল কাছে বলে যে যেভাবে পারছেন চলে আসছেন। এতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা: কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘রোগী নিয়ে আসা কিংবা লাশ দাফনের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। আগে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন লাশ দাফন করত। এখনও টুকটাক করে। কিন্তু বেশি না। তাঁদের যদি কেউ না ডাকে, তাহলে ওরা জানতে পারবে কিভাবে?’ তিনি বলেন, করোনায় মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কম। কিন্তু ঝুঁকি বেশি রোগী হাসপাতালে নেয়ার সময়। উপজেলা থেকে রোগী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সেই আসে। কিন্তু শহরের দায়িত্বটা যেহেতু সিটি করপোরেশনের, তাই তাঁদের এটি নিশ্চিত করতে হবে।’
রাজশাহী নগরীর রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) স্বাস্থ্য বিভাগের কোন অ্যাম্বুলেন্স নেই। তাই গত বছরের ২০ এপ্রিল রাসিকের ব্যবহারের জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছিলেন জানে আলম জনি নামের এক ব্যবসায়ী। সেদিন বিকালে রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের হাতে অ্যাম্বুলেন্সের চাবি হস্তান্তর করেছিলেন জনি। এরপর রাসিকের স্বাস্থ্য বিভাগে ফোন করলেই ওই অ্যাম্বুলেন্সটিতে নগরীর রোগীগুলোকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো। লাশগুলোকেও হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু কিছুদিন পরই ব্যবসায়ী জানে আলম জনি সেই অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরত নিয়েছেন।
মঙ্গলবার (০৬ জুন) বেলা ১২টার দিকে রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ওই অ্যাম্বুলেন্সটিকে (ঢাকা মেট্রো-ছ ৭১-২৮৪৬) দেখা যায়। চালক জানালেন, এই অ্যাম্বুলেন্সটিই সিটি করপোরেশনকে দেয়া হয়েছিল। পরে সেটি ফেরত নেয়া হয়েছে। এখন অ্যাম্বুলেন্সটিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা অন্যান্য দূরের গন্তব্যে হাসপাতাল থেকে রোগী ভাড়া নিয়ে যাওয়া হয়।
রাসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা এএফএম আঞ্জুমান আরা বলেন, ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্সের মত একটা গাড়ি আছে। সেটা দিয়ে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রোগী হাসপাতালে নেয়ার মত এখন কোন অ্যাম্বুলেন্স নেই। একটা অ্যাম্বুলেন্সের খুব দরকার। কেউ যদি অ্যাম্বুলেন্স দেয়, আমরা নেব।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী জানে আলম জনি যে অ্যাম্বুলেন্সটি দিয়েছিলেন, সেটি তিনি কয়দিন পরই বোধ হয় ফেরত নিয়েছেন। সেটা দিয়ে ভালই কাজ চলছিল। রোগীদের হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছিল, দাফনের কাজ করা যাচ্ছিল। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমছিল।’ যোগাযোগ করা হলে ব্যবসায়ী জানে আলম জানি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সটার মালিক তো আমি একা নই, আরও কয়েকজন আছে। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে তিন-চার মাস পর অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরত নেয়া হয়। রাসিক আবার চাইলে দেবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা তো দিতেই হবে।