নুরুল আমিন, ফুলপুর(ময়মনসিংহ): পরীক্ষার ফিস দিতে না পারায় পরীক্ষার হলে ঢুকতে দিত না স্যারেরা । তারপরও স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে একদিন সমাজে আর দশটা মেয়ের মতো বড় নারীকর্মকর্তা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে সে স্বপ্ন পূরণ না হলেও হতে পেরেছেন সফল আত্মনির্ভরশীল নারী, পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারের সম্মান । বলছি চলতি বছরে স্থানীয় সরকার পলী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কতৃক শ্রেষ্ঠ আত্মনির্ভরশীল নারী হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী ময়মনসিংহের ফুলপুরের গৃহবধু লিপি রানী চাকলাদারের কথা। জীবন সংগ্রামে জয়ী লিপি রানী চাকলাদারের জীবনের গল্প অনেকটা বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো সুখ-দুঃখে ভরপুর। নেত্রকোণা জেলার এক কৃষক পরিবারে লিপি রানী চাকলাদারের জন্ম। পিতার জমির পরিমাণ কম না থাকলেও প্রতিবছর মৌসুমী বন্যায় তলিয়ে যেত তাদের জমির ফসল ও বাড়িঘর। ফলে সারাবছর সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। ছোটবেলা থেকেই লিপি রানীর লেখাপড়ায় ছিল প্রবল আগ্রহ। সে লক্ষ্যে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যেত। প্রতিবছরই বন্যায় সব ফসল ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় অসহায় পিতার কাছ থেকে বই কেনার খরচ এমনকি পরীক্ষার ফিস জোগাড় করা অনেক সময় সম্ভব হতো না।
পরীক্ষার ফিস দিতে না পারায় স্যারেরা পরীক্ষার হলে ঢুকতে দিত না। লাঞ্ছনার শিকার হয়ে বিদ্যালয়ের বারান্দায় কত যে চোখের জল ফেলেছে, সে কথা মনে হলে এখনো লজ্জায় চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে লিপি রানীর। দারিদ্র্যের কষাঘাতে একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া। পরিবারের লোকজন কিশোরী বয়সে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন ফুলপুর উপজেলার এক বেকার ছেলের কাছে। এখানে এসে নতুন এক জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হন গৃহবধু লিপি রানী। স্বামী অঞ্জন চাকলাদার কানু স্বর্ণের দোকানে কোন রকম একটি চাকরির জোগাড় করতে সক্ষম হলেও স্বামীর যৎসামান্য আয়ে সংসার চলতো না। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হতো তাদের। স্বামীর সহযোগিতায় সংসারে কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়া করে এসএসসি ও এইসএসসি পাশ করতে সক্ষম হন লিপি। এরই মাঝে একে একে জন্ম নেয় দুই কন্যাসন্তান। একদিকে অভাব-অনটনের সংসার তার উপর মেয়ে দুটোর লেখাপড়ার খরচ। দায়িত্ব আরো বেড়ে যায় আত্মপ্রত্যয়ী জীবনসংগ্রামী লিপি রানী চাকলাদারের। নিজে পড়ালেখার সমাপ্তি টেনে মনস্থির করেন আয় রোজগার করে আত্মনির্ভরশীল হবেন তিনি। অদম্য ইচ্ছা শক্তির জেরে প্রথমেই সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ধাত্রী প্রশিক্ষণ, ডায়াবেটিস প্রশিক্ষণ, মাশর“ম চাষ প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন তিনি । ৩০০০ টাকা দিয়ে বাসায় কাপড় এনে সেলাই কাজ শুর“ করেন। এরই মধ্যে ফুলপুর পৌরসভার টাউন লেভেলে কো-অর্ডিনেটর টিএলসিসি এর সদস্য পদ লাভ করেন। এলজিইডি কর্তৃক বাস্তবায়িত নর্দার্ন বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (নবিদেপ) লিপি রানী চকলাদারকে দর্জি প্রশিক্ষক নিয়োগ কর। এরপর উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসও তাকে প্রশিক্ষক হিসাবে মনোনীত করে। ফুলপুর পৌরসভা নবিদেব ও উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস তত্ত্বাবধানে কয়েকশ’ দুস্থ অসহায় নারীকে স্বাবলম্বী করতে সেলাইকাজের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিপি রানী চাকলাদারের। সেলাই কাজ, সেলাই প্রশিক্ষণ, ধাত্রী প্রশিক্ষণ, এলাকাবাসীর ডায়াবেটিস পরীক্ষা, প্রেসার মাপা, গর্ভবতীদের পরামর্শ দেওয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ নানা উৎস থেকে আয় বাড়তে থাকে। সচ্ছলতা ফিরে আসে পরিবারে। এখন আর কারো কাছে হাত পাততে হয় না লিপি রানী চাকলাদারের।এখন নিজে এলাকার অনেক অসহায় নারীকে নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকেন তিনি। নিজের আয় দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি দুই মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন তিনি। বড় মেয়ে চৈতি চাকলাদার বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। ছোট মেয়ে স্বর্ণা চাকলাদার এনি আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতক চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছে। এনি বাংলাদেশ বেতারের একজন তালিকাভুক্ত ঘোষিকা। সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তিতে এনির রয়েছে একডেমিক প্রশিক্ষণ। এই দুই মেয়ে ছোটবেলা থেকে মাকে সেলাই কাজে সাহায্য করেছে। তারাও সেলাই কাজে পারদর্শিতা অর্জন করেছে। লিপি রানী চাকলাদার বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছেন। বর্তমানে ফুলপুর সাহিত্য পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, প্রভাতী সংঘ, গীতা পরিষদ ও মন্দির ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের সাথেও জড়িত আছেন। সম্প্রতি গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে লিপি রানী চাকলাদার তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আত্মনির্ভরশীল নারী হিসাবে দেশে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। এলজিইডি ভবন এর কামর“ল ইসলাম সিদ্দিক মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে সম্মাননা ও পুরস্কার তুলে দেন স্থানীয় সরকার পলী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপি। কর্মের স্বীকৃতি পেয়ে লিপি রানী চাকলাদারের কর্মস্পৃহা ও উদ্যম আরও অনেক বেড়ে গেছে জানান তিনি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যাংক ঋণ পেলে তিনি এখন মিনি গার্মেন্টস ও কুটিরশিল্প করার স্বপ্ন দেখছেন । এর মাধ্যমে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মহিলাদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন বলে জানান। ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শীতেষ চন্দ্র সরকার জানান, যে সকল নারী জীবনে নানা প্রতিকূলতায় হতাশায় ভুগছেন, তারা যদি লিপি রানী চাকলাদারের অনুসরণ তবে তারা হতাশা কেটে সাফল্যে মুখ দেখতে পারে। ফুলপুর পৌর মেয়র শশধর সেন বলেন, দরিদ্রতা ও হাতাশার সাথে যুদ্ধ করে লিপি রানী চাকলাদার এখন সফল নারীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।