অনলাইন ডেস্ক:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দুয়ার খুলছে আগামীকাল শনিবার। বেলা ১১টায় চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম এই সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানেলের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। এটিই দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। উদ্বোধনের পর টানেল পাড়ি দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারায় গিয়ে কোরিয়ান ইপিজেড মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। চট্টগ্রামবাসী তথা দেশবাসীর স্বপ্ন পূরণের এমন মাহেন্দ্রক্ষণে দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা থাকলেও শেষ সময়ে এসে অতি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সফর।
জানা গেছে, দুপুর ১২টায় জনসভার মঞ্চে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। জনসভা শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে আসবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর অবমুক্ত করবেন প্রধানমন্ত্রী।
দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর তলদেশে দিয়ে তৈরি হওয়া এটাই প্রথম টানেল। যার নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ। বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের পরদিন সকাল ৬টা থেকেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঢাকায় সেতু ভবনে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে সেতুমন্ত্রী বলেন, টানেল উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে পতেঙ্গা প্রান্তে। এরপর আনোয়ারা প্রান্তে কোরিয়ান ইপিজেডের মাঠে একটি জনসভা হবে। টানেলের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জাতীয় মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। কর্ণফুলী নদীর উভয় পাশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং চীনের সাংহাই শহরের ন্যায় চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি অ্যান্ড টু টাউন’ মডেলে গড়ে তোলাই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
টানেলের সার্বিক দিক তুলে ধরে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্পের এলাইনমেন্ট পতেঙ্গা প্রান্ত, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হতে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটিতে। আর টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত আনোয়ারা উপজেলার কাফকো সার কারখানার নিকটে। এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। দুই টিউব বিশিষ্ট চার লেনের টানেল প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা ও চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তা ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার হলেও মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার। ব্রিজ-ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৭২৭ মিটার (আনোয়ারা প্রান্তে), অ্যাপ্রোচ সড়কের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার, টোল প্লাজার দৈর্ঘ্য ৭ হাজার ৬০০ বর্গমিটার, আন্ডার পাস ৬টি (আনোয়ারা প্রান্তে পাঁচটি এবং পতেঙ্গা প্রান্তে একটি), কালভার্ট ১২টি, সার্ভিস এরিয়ার ৩০টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলোসহ মোটেল মেস, হেলনা সেন্টার, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিংপুল, ব্রিজ, মসজিদ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা রয়েছে। টানেল নির্মাণে বাণিজ্যিক চুক্তি হয় ২০১৫ সালের ৩০ জুন। পরের বছরের ১৪ অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। প্রধানমন্ত্রী টানেলের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। টানেল চালু হলে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। টানেলকে ঘিরে দেশের নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। সেই সঙ্গে হাজারো সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার।
টানেল চালু হলে শুধু আনোয়ারা নয়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এতে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে। টানেল প্রকল্পকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় সার কারখানা (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডে (সিইউএফএল) এবং চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ বহুবিধ শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সের (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য) মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। পদ্মা সেতুর মতো এ টানেলও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
কোন গাড়ির টোল কত: টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপের জন্য দিতে হবে ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। ৩১ বা তার চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ টাকা এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। ৫ টনের ট্রাক ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকের জন্য ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাক ৬০০ টাকা, ট্রাক (তিন এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রেইলর (চার এক্সেল) ১ হাজার টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি ট্রেইলরের জন্য ১ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা বাড়তি টোল দিতে হবে। টানেলের দুই টিউবের চার লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। এতে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে ৩ থেকে ৪ মিনিট সময় লাগবে।
পরীক্ষামূলক পারাপার: চট্টগ্রাম অফিস থেকে সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদ জানান, চট্টগ্রামে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ গতকাল বৃহস্পতিবার অতিক্রম করেছে বিশাল গাড়ির বহর। পরীক্ষামূলক এই পারাপার শেষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে প্রথম নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল এখন উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। দুপুরে টানেল অতিক্রমকালে গাড়িবহরের তিনটি কোস্টারে ছিলেন দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকগণ। পুরোভাগে ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ। গাড়িবহরে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এবং টানেল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাগণ। কর্মকর্তারা জানান, এটি ছিল টানেল উদ্বোধনের আগে চূড়ান্ত পরিদর্শন। গাড়িবহর দুপুরে বঙ্গবন্ধু টানেলের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে রওনা হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে যায়। সেখানে প্রেস ব্রিফিং শেষে শনিবার অনুষ্ঠেয় কোরিয়া ইপিজেড মাঠের জনসভার প্রস্তুতি পরিদর্শন করেন কর্মকর্তারা।
আনোয়ারা প্রান্তে বঙ্গবন্ধু টানেলের টোলপ্লাজা চত্বরে অপরাহ্নে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সরকার আশা করছে, এই টানেল চট্টগ্রাম শহরের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা আমূল বদলে দেবে এবং খুলে দেবে বাণিজ্যের বহুমুখী দুয়ার।
উত্সবের আমেজ কর্ণফুলীর দুই প্রান্তে :আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জাহিদ হাসান হূদয় জানান, প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে এখন সাজসাজ রূপ। জনসভাকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আনোয়ারার জনসভার মাঠকে ঘিরে বর্ণিল তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে পুরো চট্টগ্রাম। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে চলছে ডিজিটাল প্রচার। দলীয় প্রধানের জনসভায় নিজেদের পক্ষে শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নেতারা।
এদিকে টানেলকে ঘিরে উৎসবের আমেজ কর্ণফুলীর দুই প্রান্তে। সেখানে দুই দিনের উৎসব চলছে। গত কয়েক দিন সন্ধ্যায় পতেঙ্গা প্রান্তে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। পতেঙ্গা প্রান্ত এবং আনোয়ারা প্রান্তের সড়ক ও সড়কদ্বীপ সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। রাতে বর্ণিল আলোয় ঝলমল করছে কর্ণফুলীর দুই পাড়।