চাকরি শুরু করার কয়েক বছর পরই হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। ডান কানে কম শুনি, বাম কানে একেবারেই শোনার মতো অবস্থা নাই। দীর্ঘদিন ট্রাফিকে কাজ করেছি। এখন মাথায় সমস্যা। কোনো কিছু স্মরণ রাখতে পারি না। সময় সময় দম বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ হাসপাতাল থেকে মাসে মাসে ওষুধ নিয়ে খাচ্ছি। ডাক্তার বলেছেন, বেশি কথা বলা যাবে না।’
আলোর জগতের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন ট্রাফিক পুুলিশের কনস্টেবল রুহুল আমিন। ২০ জুলাই থেকে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে রয়েছেন তিনি। ৩৯ বছর ধরে চাকরি করেছেন। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়।
সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন আরেক কনস্টেবল নুরুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জে থাকেন তিনি। চাকরির শেষ সময় থেকে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। সেই সঙ্গে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। প্রতি মাসেই ঢাকা কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে তাকে আসতে হয় চিকিৎসার জন্য। নিয়মিতই খেতে হয় ওষুধ।
আলোর জগতের সঙ্গে আলাপ হয় নুরুল ইসলামের। তিনি বলেন, চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার কয়েক মাস আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে। সঙ্গে গ্যাস্ট্রিক। এ কারণে নিয়মিত এখন চিকিৎসা করাতে হয়। শুধু রুহুল আমিন কিংবা নুরুল ইসলামই নন, ট্রাফিক পুলিশে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যদের অনেকেই অবসরে গিয়ে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
সড়কে দাঁড়ালেই একজন সাধারণ মানুষের যেখানে যানবাহনের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায় সেখানে রোদ-বৃষ্টি অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। কেউ ৩০ বছর কেউবা ৪০ বছর ধরে প্রতিদিনই একই নিয়মে রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে সরেজমিন দেখা যায়, বহির্বিভাগে দীর্ঘ সারি। পুলিশ সদস্যদের কেউ নিজে ডাক্তার দেখানোর জন্য কেউবা পরিবারের সদস্যদের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক চার হাজার রোগী আসেন হাসপাতালটিতে। এরমধ্যে অর্ধেক পুলিশ সদস্য বাকিরা পুলিশ সদস্যদের পরিবারের মানুষ। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৪০ শতাংশ রোগীই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য। আর তাদের অধিকাংশই ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের তথ্য বলছে, রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত তিন হাজার ৬৩১ জন সদস্য রয়েছেন। এরমধ্যে দুই হাজার ৫২৪ জনই কনস্টেবল। সার্জেন্ট ৬৮৩ জন, এটিএসআই ২১৯ জন, টিএসআই ৬৩ জন এবং পুলিশ পরিদর্শক ১৪২ জন। এছাড়া ঊর্ধ্বতন পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেন। সব মিলিয়ে প্রতিদিন শুধু ঢাকা মহানগরীতেই চার হাজার সদস্য সড়কের শৃঙ্খলায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই প্রয়োজনের তুলনায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা কম। দুই শিফটে প্রতিদিনই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। শিফট পরিবর্তনের সুযোগ তেমন থাকে না। বিশ্রাম নেওয়ারও ব্যবস্থা নেই অনেক স্থানে। প্রতিদিন সড়কে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দিনের পর দিন বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের ফলে অনেকে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। আর এই স্বাস্থ্যঝুঁকি অবসর সময়ে তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিনই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের কেউ না কেউ আসেন চিকিৎসা নিতে। শ্বাসকষ্ট, সাইনোসাইটিস, মাথাব্যথা, উচ্চরক্তচাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস- এসব নানা সমস্যা নিয়ে তারা চিকিৎসা নিতে যান। দীর্ঘদিন রোদ-বৃষ্টি, ধুলাবালি, উচ্চশব্দদূষণের মধ্যে থাকা, পানি পান না করা, খাবারে অনিয়মসহ নানা কারণে তাদের এসব সমস্যা দেখা দেয়।
⇓রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. মু. মনোয়ার হাসানাত খান বলেন, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালনকালে বিশুদ্ধ খাবার পানি পান করতে পারেন না। যথাসময় খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন না। প্রয়োজন অনুযায়ী, অনেক জায়গায় টয়লেট ব্যবহার করতে না পারায় নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি হয়। শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের সমস্যা, খাবারে অনিয়মজনিত সমস্যা, ইউরিন সমস্যা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, উচ্চরক্তচাপসহ নানা সমস্যা নিয়েই আসেন তারা।
ট্রাফিক পুলিশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালনের সময় তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য উন্নতমানের মাস্ক দেওয়া হয়। দেশে তেমন ব্যবস্থা নেই। এখানে সাধারণ মাস্ক ব্যবহার করতে চাইলেও সেটি নিজের টাকায় কিনে নিতে হয়। যদিও করোনাকালে সরকারিভাবেই এটা দেওয়া হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের জন্য সব জায়গায় ট্রাফিক বক্স সুবিধাও নেই। কোনো কোনো বক্সে নেই শৌচাগার। সেসব জায়গায় দায়িত্বরতদের আশপাশের মার্কেট, মসজিদ কিংবা পাবলিক শৌচাগারই ব্যবহার করতে হয়। এতে নারী ট্রাফিক পুলিশদের চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আবার অধিকাংশ ট্রাফিক বক্স পুলিশের ব্যক্তিগত বা কোনো কোম্পানি বা সংস্থার সহযোগিতায় করা। এগুলো স্থাপনের জন্য আবার নিতে হয় সিটি করপোরেশনের অনুমতি। কোনোটার অনুমতি না থাকলে ভেঙে ফেলতে হয়। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, নিয়মিত যথাসময়ে খাবার গ্রহণ করতে না পারাসহ নানা কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়েন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ট্রাফিক পুলিশ বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের জটিলতা, চর্মরোগ ও শ্রবণশক্তিজনিত সমস্যায় ভোগেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সময়মতো খাওয়ার সুযোগও হয় না। প্রয়োজনমতো বিশুদ্ধ পানিও পান করতে পারেন না। আবার এটি অনেকটা শারীরিক পরিশ্রমেরও কাজ। ফলে অনেকে নানা ধরনের সমস্যায় পড়েন, বিশেষত একটু বয়স্ক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা নানা রোগে আক্রান্ত হন। অবসরে যাওয়ার পর তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা আরও জটিল হয়।
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সমস্যা সমাধানে পুলিশের কী ধরনের ভূমিকা থাকে- জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ট্রাফিকে চাকরিতে থাকা অবস্থায় কেউ যদি কোনো সমস্যায় পড়েন আমরা সবসময় সেটা দেখি। এছাড়া আমাদের নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে যেখানে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমি একটি উদ্যোগ নিতে চাই সেটা হলো যাদের ৪০ এর বেশি বয়স তাদের আমরা নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করাবো। যাতে কোনো সমস্যা থাকলে সে বুঝতে পারে। অনেকেই আছেন অনেক সমস্যা কিন্তু সে জানেন না। পরে একদিন দেখা যায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন। এ জন্য অফিসিয়ালি আমরা পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করবো।