জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অত্যন্ত কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে সামান্যতমও ছাড়ও দিচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ নানাভাবে গত ১৫ বছর এ সরকার জামায়াতকে রাজনৈতিক অঙ্গণে কোনঠাসা করে ফেলেছে।
আগামী নির্বাচনেও জামায়াত যাতে সরাসরি অংশ নিতে না পারে সে জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে এ দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষদ্ধ করার জন্য উচ্চ আদালতে আবেদনও করা হয়েছে। এর মাধ্য জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। এ অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এ দলটি এক ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলবদল একটি স্বভাবিক বিষয়। নীতি-আদর্শের কথা ভুলে ফায়দা লুটতে অতীতে অনেকেই যোগ দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলে। এক দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেওয়ার এই প্রক্রিয়াটি জামায়াতে ইসলামী একটু ভিন্ন ভাবে গ্রহণ করেছে।
তারা দলবদল না করে সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের সাথে মিশে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা এটাকে এখন অনুপ্রবেশ বলেই অখ্যায়িত করছে। এই প্রক্রিয়ায় জামায়াত-শিবির ছেড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। আর এই অনুপ্রবেশ স্রোতের আকার ধারণ করে ২০১৪ সালে চারদলীয় জোটের সহিংস আন্দোলন দমে যাওয়ার পর থেকে। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জামায়াত-শিবির ও বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে নয়। কিন্তু তার পরও অনুপ্রবেশ থেমে নেই। নানা প্রক্রিয়ায় জামায়াত-শিবির থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের পর অনেকে পদ-পদবিও বাগিয়ে নিচ্ছেন।
বর্তমানে ঢালাওভাবে এই প্রক্রিয়া বন্ধ থাকলেও এরই মধ্যে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে বসে পড়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের দমন-পিড়ন থেকে বাঁচতে এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই সুক্ষ্ম কৌশল অনেক স্থানেই বেশ সফল হয়েছে। আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন থেকে পৌর এবং জেলা কমিটির বিভিন্ন পদেও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের অধিষ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, শিবির থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার অভিযোগও দলের মধ্যে বেশ আলোচিত।
এর মধ্যে অনেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে চেয়ারম্যান ভাইস-চেয়ারম্যানও হয়েছেন। এবার তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করেছেন। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ অথবা অন্য কোন অঙ্গসংগঠনে মিশে যাওয়া জামায়াত শিবিরের এইসব নেতারা আগামী জাতীয় সংসদে প্রার্থী হওয়ারও জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন। বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় তার বাড়ি। শিবির নেতা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে বেশ জোরালোভাবেই সর্বত্র আলোচিত। এবার তিনি মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। সে লক্ষ্যেই এলাকায় বিভিন্ন সভা-সংযোগ করছেন নিয়মিত। এস এম জাকির উপজেলার হালগরা গ্রামের হাফিজ মাওলানা আব্দুল জলিল (বড় হাফিজ) এর ছেলে।
জাকিরের পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্য জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত বলে এলাকায় আলোচনা রয়েছে। তার পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন কেউই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের আদর্শে বিশ্বাস করেনা। জাকির এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন জামায়াত প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা জামেয়া ক্বাসিমিয়া নরসিংদিতে। এই মাদ্রাসায় জামায়াত শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারের সন্তানরাই লেখা পড়া করে। শিবিরের কর্মী, সাথী বা সদস্য পর্যায়ের না হলে সেখানে পড়া লেখা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। জাকির সেখান থেকে আলীম পাশ করেন। সারাদেশে শিবিরের দূর্গ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত জামেয়া ক্বাসিমিয়া নরসিংদি। সেই জাকির এবার দলের টিকেট পেতে বর্তমান সংসদ সদস্য, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে দলের ভেতরে দল ও কোন্দল তৈরি হয়েছে। চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে নেতা-কর্মীদের মাঝে। আলোচনায় উঠে আসছে তার শিবির নেতা থেকে ছাত্রলীগ হয়ে উঠার গল্প। জুড়ী উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক ও মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ বদরুল ইসলাম বলেন, ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক হওয়ার আগমুহুর্ত পর্যন্ত আমরা জানতাম না এসএম জাকির হোসাইন নামে কোন ছাত্রলীগ নেতা বা কর্মী আমাদের এলাকায় আছে। তার গোটা পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। এখন তিনি আওয়ামীলীগের টিকিটে এমপি হতে চান। দল তাকে নমিনেশন দিলে আওয়ামী রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। শুধু অনুপ্রবেশকারী নয়, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় জামায়াত থেকে অনেকে আওয়ামী লীগের সরাসরি যোগদানও করেছেন।
এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় নাশকতা মামলার একাধিক অভিযুক্ত জামায়াত-শিবির নেতা বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা। ২০১৬ সালে বিজয়ের মাসে আওয়ামী লীগে যোগ দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারঘরিয়া ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মাওলানা আবুল খায়ের। তার আগে একই বছর ১ অক্টোবর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা সোহরাব আলী, জামায়াতের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় নেতা আফরোজ জুলমত আলী, জামায়াত নেতা আবদুল্লাহহেল বাকী, মিজানুর রহমান আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এঁরা সবাই একাধিক নাশকতা মামলার আসামি। যোগ দেওয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁদের মামলাগুলো অন্তরালে চলে যায়।
২০১৫ সালের ৮ জুন জয়পুরহাটে আওয়ামী লীগের এমপি সামছুল আলম দুদুর হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন নাশকতা ও সহিংসতার ১০ মামলায় অভিযুক্ত পাঁচবিবি উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আবদুস সালাম। ২০১৫ সালে শিবির থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন রাজশাহী বাগমারার উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মোল্লা এম আলতাফ হোসেন। একসময় তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবির রাজশাহী পশ্চিম সাংগঠনিক জেলার সভাপতি। একই বছর আওয়ামী লীগে যোগ দেন বাগমারায় বাংলা ভাইয়ের সহযোগী হিসেবে পরিচিত জেএমবি নেতা আবদুস সালাম। তিনি বর্তমানে বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক। পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার বালিপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শেখ শামীম বর্তমানে একই ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার প্রভাবশালী জামায়াত নেতা, উপজেলা জামায়াতের সাবেক সদস্য রেজাউল করিমকে শ্যামনগরের কৈখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়েছে।
শ্যামনগরের আটালিয়া ইউনিয়ন শিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান বর্তমানে ওই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে। কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সামনে রেখে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কাউন্সিল শুরু হয় ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। চলে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। তবে তৃণমূলে কোন্দল ও রাজনৈতিক চাপে প্রায় ৫০ ভাগ ইউনিটে কাউন্সিল হতে পারেনি। এসব কাউন্সিল না করেই কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছিল। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জামায়াত থেকে যারা ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে তাদের একটি অংশ দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের পদ-পদবি পেয়েছে।
যারা পদ-পদবি পায়নি তাদের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা পরিচালনা পরিষদ, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। দলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ ও পদ-পদবি পাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, সারাদেশে আমাদের বিশাল নেতাকর্মী রয়েছে। এর মধ্যে কোন কোন স্থানে হয়তো কিছু অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এর মধ্যে হয়তো কেউ কেউ গোপনে পদও বাগিয়ে নিতে পারে। তবে নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া অসম্ভব। ত্যাগি এবং পরিক্ষীত নেতারাই কেবল আগামীতে দলীয় মনোনয়ন পাবেন।