ঢাকা ০৮:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বহন করছে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মায় (বর্তমানের মিয়ানমার) সংঘটিত যুদ্ধে মোট ৪৫ হাজার কমনওয়েলথ যোদ্ধা নিহত হন। নিহত যোদ্ধাদের বিভিন্ন দেশে সমাধি গড়ে সেখানে সমাহিত করা হয়। যুদ্ধে মিয়ানমার, আসাম এবং বাংলাদেশে মোট ৯টি স্থানে নিহত যোদ্ধাদের সমাধি গড়া হয়। তার মধ্যে অন্যতম কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি।

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি ৪ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে বিশ্বের ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন কমনওয়েলথ যোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অবিভক্ত ভারতের ১৭৮, যুক্তরাজ্যের ৩৫৭, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, জাপানের ২৪, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের ৪, রোডেশিয়ার ৩ জন ও দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড ও বার্মার একজন করে যোদ্ধার সমাধিক্ষেত্র এই ওয়ার সিমেট্রি।

ধর্ম অনুসারে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে ইসলাম ধর্মের ১৭২ জন, বৌদ্ধ ধর্মের ২৪ জন, হিন্দু ধর্মের ২ জন আর বাকী সবাই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী যোদ্ধা সমাহিত আছেন। নিহত এসব যোদ্ধাদের মধ্যে ৫৬৭ জন নাবিক, ১৬৬ জন বৈমানিক ও ৩ জন সৈনিক।

ইতিহাস কাঁধে করা চলা এই ওয়ার সিমেট্রিটি কুমিল্লা শহর থেকে থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পশ্চিম পাশে সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত। বিপরীত পাশে বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের ফরিজপুর গ্রাম। এ স্থানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অম্লান স্মারকচিহ্ন বহন করে চলেছে। এখানে প্রায় দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষকসহ দর্শনার্থীদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো।

ওয়ার সিমেট্রি ঘুরে দেখা গেছে, সমাধিস্থল এলাকায় সবুজ ঘাসের গালিচায় শোভা পাচ্ছে হরেক রকমের ফুল। গাছগাছালি ঘিরে সুনসান নীরবতা। সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে রয়েছে একটি তোরণ ঘর। এর ভেতরের দেওয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাসের বিবরণ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লেখা রয়েছে। ভেতরে যাওয়ার জন্য রয়েছে প্রশস্ত পথ, যার দুই পাশে সারি সারি কবরের ফলক। যোদ্ধাদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক রয়েছে। প্রশস্ত পথ ধরে সামনে রয়েছে সিঁড়ি দেওয়া বেদি, তার ওপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিষ্ট ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুই পাশে রয়েছে আরও দুটি ঘর। এসব ঘরের মধ্য দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পেছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরও বহু কবর ফলক। প্রতি দুটি কবর ফলকের মধ্যখানে আছে একটি করে ফুলগাছ। এছাড়া পুরো সমাধিস্থলে রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত অনেক গাছ। কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালপালা ছড়িয়ে আছে। ঝিরঝিরে বাতাসে রং-বেরঙের ফুল ও বাহারি পাতার গাছ দোল খাচ্ছে। যেন গাছগুলোও ফুল ছিটিয়ে যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য, চোখ ফেরানো যায় না প্রকৃতির নান্দনিক শোভা এই ওয়ার সিমেট্রি থেকে।

কমনওয়েলথ গ্রেড ইয়ার্ড কমিশন ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে সব ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে একটি বার্ষিক প্রার্থনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটিতে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের হাইকমিশনার, প্রতিনিধিগণকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে তারা যুদ্ধ সমাধির হলিক্রস পাদদেশে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্য দিয়ে নিহত সৈনিকদের স্মরণ করেন। এ সময় করুণ সুর বেজে ওঠে প্রার্থনার ধ্বনি।

প্রার্থনা শেষে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের প্রতিনিধিগণ ও চিরনিদ্রায় শায়িত সৈনিকদের পরিবার সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থীও নিহত সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বছরের অন্যান্য সময়ও এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে।

আপলোডকারীর তথ্য

মির্জাগঞ্জে রাতের আধারে বসতঘর লুটপাট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বহন করছে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

আপডেট টাইম : ১০:০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৩

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মায় (বর্তমানের মিয়ানমার) সংঘটিত যুদ্ধে মোট ৪৫ হাজার কমনওয়েলথ যোদ্ধা নিহত হন। নিহত যোদ্ধাদের বিভিন্ন দেশে সমাধি গড়ে সেখানে সমাহিত করা হয়। যুদ্ধে মিয়ানমার, আসাম এবং বাংলাদেশে মোট ৯টি স্থানে নিহত যোদ্ধাদের সমাধি গড়া হয়। তার মধ্যে অন্যতম কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি।

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি ৪ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে বিশ্বের ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন কমনওয়েলথ যোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অবিভক্ত ভারতের ১৭৮, যুক্তরাজ্যের ৩৫৭, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, জাপানের ২৪, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের ৪, রোডেশিয়ার ৩ জন ও দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড ও বার্মার একজন করে যোদ্ধার সমাধিক্ষেত্র এই ওয়ার সিমেট্রি।

ধর্ম অনুসারে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে ইসলাম ধর্মের ১৭২ জন, বৌদ্ধ ধর্মের ২৪ জন, হিন্দু ধর্মের ২ জন আর বাকী সবাই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী যোদ্ধা সমাহিত আছেন। নিহত এসব যোদ্ধাদের মধ্যে ৫৬৭ জন নাবিক, ১৬৬ জন বৈমানিক ও ৩ জন সৈনিক।

ইতিহাস কাঁধে করা চলা এই ওয়ার সিমেট্রিটি কুমিল্লা শহর থেকে থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পশ্চিম পাশে সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত। বিপরীত পাশে বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের ফরিজপুর গ্রাম। এ স্থানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অম্লান স্মারকচিহ্ন বহন করে চলেছে। এখানে প্রায় দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষকসহ দর্শনার্থীদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো।

ওয়ার সিমেট্রি ঘুরে দেখা গেছে, সমাধিস্থল এলাকায় সবুজ ঘাসের গালিচায় শোভা পাচ্ছে হরেক রকমের ফুল। গাছগাছালি ঘিরে সুনসান নীরবতা। সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে রয়েছে একটি তোরণ ঘর। এর ভেতরের দেওয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাসের বিবরণ ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় লেখা রয়েছে। ভেতরে যাওয়ার জন্য রয়েছে প্রশস্ত পথ, যার দুই পাশে সারি সারি কবরের ফলক। যোদ্ধাদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক রয়েছে। প্রশস্ত পথ ধরে সামনে রয়েছে সিঁড়ি দেওয়া বেদি, তার ওপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিষ্ট ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুই পাশে রয়েছে আরও দুটি ঘর। এসব ঘরের মধ্য দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পেছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরও বহু কবর ফলক। প্রতি দুটি কবর ফলকের মধ্যখানে আছে একটি করে ফুলগাছ। এছাড়া পুরো সমাধিস্থলে রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত অনেক গাছ। কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালপালা ছড়িয়ে আছে। ঝিরঝিরে বাতাসে রং-বেরঙের ফুল ও বাহারি পাতার গাছ দোল খাচ্ছে। যেন গাছগুলোও ফুল ছিটিয়ে যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য, চোখ ফেরানো যায় না প্রকৃতির নান্দনিক শোভা এই ওয়ার সিমেট্রি থেকে।

কমনওয়েলথ গ্রেড ইয়ার্ড কমিশন ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে সব ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে একটি বার্ষিক প্রার্থনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটিতে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের হাইকমিশনার, প্রতিনিধিগণকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে তারা যুদ্ধ সমাধির হলিক্রস পাদদেশে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্য দিয়ে নিহত সৈনিকদের স্মরণ করেন। এ সময় করুণ সুর বেজে ওঠে প্রার্থনার ধ্বনি।

প্রার্থনা শেষে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের প্রতিনিধিগণ ও চিরনিদ্রায় শায়িত সৈনিকদের পরিবার সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থীও নিহত সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বছরের অন্যান্য সময়ও এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে।